শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১১

ইসলাম কত প্রকার? অন্ততঃ ৫ প্রকারের। আপনি কোন্ ক্যটাগরীতে?

ইসলাম এক ও অভিন্ন প্রকারের। তবে সেটি হলো তাত্ত্বিক ইসলাম। যা রেখে গেছেন প্রফেট মুহাম্মদ (সঃ), অনুসরণ করেছেন সাহাবীগণ প্রমুখ। সমাজে, বাস্তবে ইসলাম আছে ৫ প্রকারের। বলা যায়, লোক ইসলাম ৫ ধরনের। দেখুন আপনি একমত হতে পারেন কি নাঃ

১. ইসলাম লায়াবিলিটি হিসাবে।

২. ইসলাম ঐতিহ্য হিসাবে।

৩. ইসলাম পেশা হিসাবে।

৪. ইসলাম পরিচিতি হিসাবে।

৫. ইসলাম পছন্দ হিসাবে।

১. ইসলাম লায়াবিলিটি হিসাবে – তাঁদের কাছে যারা জীবনের একসময়ে মাদ্রাসায় পড়েছেন, বা ইসলামী সংগঠন করেছেন বা যাদের পরিবারে ইসলাম চর্চা হয় বা হতো; কিন্তু এখন তাঁরা সর্বোতভাবে চেষ্টা করেন যাতে লোকে জানতে না পারে যে উনার একটা ইসলামী অতীত বা ব্যকগ্রাউন্ড আছে। অতীতের ইসলাম পরিচিতিকে লুকানোর জন্য কখনো কখনো এরা ইসলামপন্থীদের উপর খড়গ-হস্তও হয়ে থাকেন।

২. ইসলাম ঐতিহ্য হিসাবে – তাঁদের কাছে যারা একসময়ে মাদ্রাসায় পড়েছেন বা পরিবারে ইসলাম চর্চা হয় বা হতো; সে হিসাবে এখনও নামাজ পড়েন, পর্দা করেন; যতটুকু সম্ভব ইসলামী অনুশাসন অনুশীলন করেন। তবে, নিজের স্বার্থকে একেবারে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। ইনাদের চিন্তা-ভাবনায় যে ইসলাম সেটি নিতান্তই ব্যক্তিগত। ইসলামের জন্য প্রয়োজনে জীবনও দিয়ে দিব – ইনাদের মাথায় এটি কখনো আসেনা। ইনাদের ইসলাম, বলা যায়, মুসলিম লীগ মার্কা ইসলাম।

৩. ইসলাম পেশা হিসাবে – তাঁদের কাছে যারা ইসলাম-এর চাকুরী করেন। যেমন- মাদ্রাসার হুজুরেরা, পীর ও তদীয় খাদেমগণ, মসজিদের বেতন-ভূক ইমাম সাহেবানরা, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী বিষয়াদির শিক্ষকগণ ও ইসলামী সংগঠনের ফুল-টাইমার / সুবিধাভোগী দায়িত্বশীলগণ। প্রচলিত আছে, ইমামতির চাকুরী না করলে অনেক হুজুর পাঁচ বেলা মসজিদেও যেত না।

ইনারা নিজেদেরকে ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া দাবী করেন। কিন্তু মনে করেন, এটি পাবলিকের দায়িত্ব, তাঁদের কাছে আসা, ইসলাম ‍বুঝে নেয়া। নবীরা মানুষের কাছে যেতেন এবং পারিশ্রমিক না নেয়ার বিষয়টিকে তাঁদের বক্তব্যের পক্ষে দাবী হিসাবে লোকদের বলতেন। [বিঃদ্রঃ শিক্ষাদানের মাধ্যমে পারিশ্রমিক গ্রহন বৈধ হলেও দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য কোন প্রকারের বৈষয়িক বিনিময় গ্রহন সম্পূর্ণ অবৈধ।]

এসব পেশাধারী ইসলামপন্থীরা নিজেদের জন্য রুখসত (জায়েযের সর্বনিম্ন সীমা) অবলম্বন করলেও ওয়াজ করার সময় বা হেদায়াতী বক্তব্য রাখার সময় অত্যন্ত কঠোরভাবে (নাকি নির্লজ্জভাবে?) আযীমতের (সর্বোচ্চ মান) বয়ান করেন।

৪. ইসলাম পরিচিতি হিসাবে – তাঁদের কাছে যারা মূলত অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে থাকেন। ইসলাম তাঁদের সোশ্যাল আইডেন্টিটি। এরা প্রায়শঃই এপলোজেটিক হয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে এরা ইসলাম পছন্দ ক্যটাগরীতে উন্নীত হন – এমন নজীর বিদ্যমান।

৫. ইসলাম পছন্দ হিসাবে আছেন তাঁরা যারা ইসলামকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আদর্শ হিসাবে মেনে চলেন। এরা ইসলাম বুঝেন, যথাসম্ভব মানেন। এই দলের লোক আবার তিন ধরনের। চরমপন্থী, নন-অফেনসিভ চরমপন্থী ও মধ্যপন্থী।

ক. ইসলাম তাঁদের চয়েস অথচ চরমপন্থী হচ্ছেন তাঁরা যারা বোমা মেরে প্রচলিত আদালতের বিচারকদের হত্যা করতে চান, এজন্য যে, এসব বিচারক আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা করেন না, যেখানে আল্লাহর বাণী হলো – যারা ইসলামের বিধান ব্যতিরেকে বিচার-ফয়সালা করেন তাঁরা কাফির …. । আক্বীদাগত দিক থেকে এরা ইসলাম বুঝলেও বিদ্যমান সমাজে ইসলামের বাস্তবায়নের ব্যাপারে এরা অত্যন্ত দূর্বল জ্ঞান রাখেন। এরা যে কোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সুকুমারবৃত্তি চর্চাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন।

খ. এরা কখনো নন-অফেনসিভ এক্ট্রিমিষ্টও থাকেন। ইসলামের শুধুমাত্র লোকপ্রিয় (মূলতঃ ধর্মীয়) দিকগুলো, যেমন স্পিরিচুয়ালিটি ইত্যাদি নিয়ে এরা থাকেন। এরা ইসলামিক পিউরিটানিজমে ভোগেন। ইসলাম পছন্দ চরমপন্থী ও মধ্যপন্থীদেরকে এরা সরাসরি অন্যতম বাতেল মনে করেন। এরাও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে অনুৎসাহিত করেন। ইনারা আমলবাদী।

গ. ইসলাম পছন্দ দলের মধ্যকার মধ্যপন্থী হচ্ছেন তাঁরা যারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধানাবলীকে সামাজিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করে ইসলামের বিধানাবলী সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। ইনারা ইসলামী আন্দোলনের লোক। নারীদের ব্যাপারে এরা উদার মনোভাবাপন্ন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সুকুমার চর্চাকে এরা জরুরী মনে করেন। সোশ্যাল মেচুরিটি – এদের যে কোন পলিসির মাপকাঠি হিসাবে কাজ করে। সমাজের সকল স্তর হতে লোকজন নিয়ে এই ক্যটাগরী।


আসুন এবার আত্মপর্যালোচনা করে দেখি আমি/আপণি কোন্ দলে।

ইসলামী উত্তরাধিকার আইনঃ একটি পর্যালোচনা

সার-সংক্ষেপঃ ক. নারীরা পুরুষের পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন – এটি ভুল ধারনা। নারীরা কখনো কম, কখনো বেশী ও কখনো সমান পেয়ে থাকেন। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু নারীরাই পেয়ে থাকেন। যেমন- (১) ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের কেবলমাত্র ৪টি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অর্ধেক পান। (২) ৪টি ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের আত্মীয় হওয়া সত্বেও পুরুষ পুরোপুরি বঞ্চিত হন। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট নারী পান, পুরুষ কিছুই পাননা। (৩) ১২টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় নারী অধিক পরিমাণে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন। (৪) ১০ অবস্থায় নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের সমান পেয়ে থাকেন।

খ. উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের তুলনায় সর্বমোট সম্পত্তি কম পেলেও উপার্জন ও সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব হতে মুক্ত থাকায় নারীদের উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ পর্যাপ্ত হওয়ার কথা।

গ. মৃত সন্তানের পরিবারের সুরক্ষার জন্য মোট সম্পত্তির অনূর্ধ এক-তৃতীয়াংশ ওছিয়ত করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব, যা নিশ্চিত করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

ঘ. ইসলামী রাষ্ট্র মানেই সবার জন্য ইসলামী উত্তরাধিকার আইন – এমনটি নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যারা এটিকে মানতে চাইবে (যেমন মুসলিমগণ)।

ঙ. ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূল ভিত্তি হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক নির্ভর পরিবার ব্যবস্থা যার মূলনীতি হলো পারিবারিক দায়িত্বনির্ভর অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা।

চ. নারী-পুরুষের মানবিক মর্যাদা অভিন্ন হওয়া সত্বেও প্রাকৃতিকভাবে নারী ও পুরুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা ভিন্নতর। এই দৃষ্টিতে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ছ. নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে পূঁজি করে আমাদের সমাজে নারীদের উপর চলমান সকল অ-মানবিক বৈষম্য রোধে আমাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা উচিত।

ভূমিকাঃ ক. ইসলামী উত্তরাধিকার আইনঃ একটি পর্যালোচনা – এই প্রবন্ধটিতে সকল আলোচনা ইসলামী উত্তরাধিকার আইনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাই, যারা এটিকে গ্রহনযোগ্য মনে করবেন না (যেমন অমুসলিমরা) তাঁদের পূর্ণ অধিকার থাকবে নিজস্ব পারিবারিক আইন অনুযায়ী জীবন যাপনের।

খ. ইসলামের উত্তরাধিকার আইন ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। ইসলামী সমাজ পরিবার কেন্দ্রিক। পরিবার বলতে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কনির্ভর চিরায়ত পরিবার ব্যবস্থাকেই বোঝানো হয়েছে।

গ. ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ‘ইসলাম অনুযায়ী ঠিক আছে’ – এটি দেখানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অগ্রহনযোগ্য – এটি দেখানোও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

ঘ. তাই, ইসলামের মূলনীতির সাথে এ বিষয়টি সুসামঞ্জস্য কিনা এটি দেখার সাথে সাথে আমরা যাচাই করার চেষ্টা করবো - একটি প্রস্তাবণা হিসাবে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন যুক্তিসংগত কিনা।

ঙ. পুরো আলোচনাটিকে প্রশ্ন-উত্তর ধরনে সাজানো হয়েছে।

প্রশ্ন১- আমি যখন আমার ছেলে-মেয়েকে লালনপালনের সময় কোন পার্থক্য করিনা, তখন আমার মেয়েটি কেন উত্তরাধিকার প্রাপ্তির সময় তাঁর ভাইয়ের অর্ধেক পাবে?

উত্তরঃ আপনার/আমার কন্যা শিশুটি বড় হয়ে মা হবেন, ধারনা করা যায়, তিনি একটি পরিবারে মাতৃত্বের দায়িত্বপালন করবেন। একটি পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ে, এমনকি সন্তানেরাও উপার্জন করতে পারে। তৎসত্বেও, উপার্জনের দায়িত্ব এককভাবে শুধুমাত্র পিতার। কন্যা সন্তানটির তাবৎ ব্যয়নির্বাহের দায়িত্ব কখনোই তাঁর উপরে বর্তায় না। তাই, উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রেও তাঁকে কোন কোন ক্ষেত্রে কম দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন২- পরিবার প্রতিপালনে অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব হতে পুরোপুরি অব্যাহতি দেয়ার পর কন্যা সন্তানদেরকে আদৌ সম্পদের অংশীদার করা হলো কেন?

উত্তরঃ ব্যক্তিত্ব ও মানবীয় মর্যাদা নিশ্চিতকরণের অন্যতম অপরিহার্য শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা (সাপোর্ট) থাকা। নারীদের ক্ষেত্রে মোহরানা (ম্যরেজ গিফট) ও মিরাছ (স্বজন ও আত্মীয়দের সম্পদ-সম্পত্তিতে প্রাপ্যতা) –এর মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী মতাদর্শই প্রথম নারীদের এই একান্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক তথা মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অবধি এর কোন বিকল্প নাই।

প্রশ্ন৩- নারীদেরকে সম্পত্তির অর্ধেক দেয়ার নিয়ম কেন?

উত্তরঃ সর্বক্ষেত্রে কম দেয়া হচ্ছে – এই বদ্ধমূল ধারনাটা ভুল। কেবলমাত্র ৪টি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট পুরুষের অর্ধেক পেয়ে থাকেন। যেমন:

১(১). মৃতের ছেলে ও মেয়ে সন্তান জীবিত থাকলে অন্য কোন স্বজন উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না। তখন মৃতের সম্পত্তি পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে মৃতের মোট সম্পত্তির ৩ভাগের ২ভাগ ছেলে সন্তান পাবেন ও ১ভাগ মেয়ে সন্তান পাবেন।

১(২). মৃতের শুধুমাত্র পিতা ও মাতা জীবিত থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৩ভাগের ২ভাগ পিতা পাবেন। ১ভাগ মাতা পাবেন।

১(৩). মৃতের ১জন ভাই ও ১জন বোন থাকলে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাই পাবেন ৩ভাগের ২ভাগ, বোন পাবেন ১ভাগ।

১(৪). অনুরূপভাবে মৃতের জীবিত আত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে মরহুমের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ৩ভাগের মধ্যে বৈমাত্রেয় ভাই ২ভাগ ও বৈমাত্রেয় বোন ১ভাগ পরিমাণে প্রাপ্য হবেন।

নারীদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় কখনো বেশী দেয়া হয়, কখনো সমান দেয়া হয়, কখনো কম দেয়া হয়। সর্বোপরি উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তি কম পেলেও অর্থনৈতিক দায়মুক্ত থাকার কারনে নারীদের মোট উদ্বৃত্ত সম্পদ (আসলে পুরোটাই উদ্বৃত্ত) তাঁদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় অবশ্যই বেশী হওয়ার কথা। আমাদের সমাজে এতদসংশ্লিষ্ট ইসলামী আইনের প্রয়োগ ও সুষম প্রয়োগ না থাকার বিষয়টা নিতান্তই বেদনাদায়ক।

ইসলামের আইন ও এর নীতি-আদর্শভিত্তিক এই তাত্ত্বিক হিসাব এবং আমাদের বাংলাদেশে এর বিপরীত করুন সামাজিক বাস্তবতার বিষয়টা অতি-স্পষ্ট হওয়ায় এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনা নিস্প্রয়োজন মনে করছি।

প্রশ্ন৪- নারীরা পুরুষের বেশী পান - এ’রকম কোন প্রমাণ কি আছে?

উত্তরঃ সুরা নিসার ৭,৮,১১ ইত্যাদি আয়াতে উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি বর্ণিত আছে। সে অনুসারে নীচের হিসাবটা দেখুন:

২(৫) মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা, কন্যা ও ছেলের কন্যা বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী পাবেন ৩ভাগ, পিতা পাবেন ২ভাগ, মাতা পাবেন ২ভাগ, কন্যা পাবেন ৬ভাগ, ছেলের কন্যা পাবেন ২ভাগ।

এক্ষেত্রে মৃতের ছেলের ঘরের কন্যা না থেকে পুত্র থাকলে সেই পুত্র কিছুই পাবে না। হিসাবটা নিম্নরূপ –

মৃতের সম্পত্তির ১৩ভাগ করে =

স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + কন্যা ৬ভাগ + ছেলের ছেলে ০ভাগ।

২(৬) মৃতের জীবিত স্বজনদের মধ্যে স্বামী, সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ভাগ করে স্বামীকে দিতে হবে ৬ভাগ, সহোদর বোনকে দিতে হবে ৬ভাগ ও বৈমাত্রেয় বোনকে দিতে হবে ৩ভাগ।

অথচ, মৃতের বৈমাত্রেয় বোন না থেকে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে, তিনি সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষ হওয়া সত্বেও কিছু পাবেন না। তখন হিসাবটা হবে নিম্নরূপ: মৃতের সম্পত্তি ২ভাগ = স্বামী ১ভাগ + সহোদর বোন ১ভাগ + বৈমাত্রেয় ভাই ০ভাগ। বাদ পড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মতো বৈমাত্রেয় ভাইও তাঁর বৈমাত্রেয় বোনের রেখে যাওয়া সম্পত্তির কোন অংশের উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না।

২(৭) মৃতের স্বজনদের মধ্যে শুধুমাত্র পিতা, দাদা ও দাদী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৬ভাগের ৫ভাগ পাবেন পিতা আর দাদী পাবেন ১ভাগ। দাদা কিছু পাবেন না।

২(৮) শুধুমাত্র নানা ও নানী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির পুরোটাই নানী পাবেন। নানা কিছু পাবেন না।

প্রশ্ন৫- উত্তরাধিকার বন্টনের নিয়ম (তথা এই ‘বৈষম্যে’র (?) হেতু) কী?

উত্তরঃ ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে ১২জনের অংশ নির্ধারিত। এদের ৮জনই নারী (মা, মেয়ে, স্ত্রী, ছেলের মেয়ে, সহোদরা বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় বোন, দাদী, নানী)। নির্ধারিত উত্তরাধিকার পাবে এমন পুরুষের সংখ্যা ৪জন (বাবা, স্বামী, দাদা ও মা-এর দিক থেকে ভাই)। এই ৪জন পুরুষ ছাড়া সকল পুরুষ উত্তরাধিকারী ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘আসাবা’ বা অবশিষ্টাংশ ভোগী। ‘যাবিল ফুরুজ’ হিসাবে নির্ধারিত অংশসমূহ বন্টিত হওয়ার পরে ‘আসাবা’রা (অধিকাংশই পুরুষ) পেতেও পারেন নাও পেতে পারেন। যেমনটি উপরের ৪টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষগণকে ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে এবং সমপর্যায়ের নারীকে প্রাধান্য বা পুরোটাই দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন৬- নারীরা সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অধিক পাবেন কখন?

উত্তরঃ ৩(৮) মৃতের স্বামী, ১কন্যা ও চাচার উপস্থিতিতে মৃতের সম্পত্তি ৪ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী ১ভাগ, চাচা ১ভাগ ও কন্যা ২ভাগ পাবেন।

৩(৯) উপরের হিসাবে যদি কন্যা ২জন হন, তাহলে মৃতের সম্পত্তি ১২ভাগ করা হবে। সেক্ষেত্রে কন্যারা ৪ভাগ করে মোট ৮ভাগ পাবেন, স্বামী পাবেন ৩ভাগ ও চাচা পাবেন ১ভাগ।

৩(১০) মৃতের ১কন্যা ও ও ২ভাই থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৪ভাগের ২ভাগ পাবেন কন্যা আর ভাইয়েরা পাবেন ৪ভাগের ১ভাগ করে।

৩(১১) মৃতের স্বামী, ২জন সহোদরা বোন ও মা থাকলে মৃতের সম্পত্তি ৮ভাগ করে এর ৩ভাগ পাবেন স্বামী, ২বোন পাবেন ৪ভাগ ও মা পাবেন ১ভাগ। অথচ, মৃতের স্বামী ও মা-এর উপস্থিতিতে ২ বোনের পরিবর্তে ২ভাই থাকলে স্বামী পাবেন ৬ভাগের ৩ভাগ, মা পাবেন ১ভাগ ও ২জন ভাই-এর প্রত্যেকে পাবেন ৬ভাগের ১ভাগ করে।

৩(১২) অনুরূপভাবে মৃতের বৈমাত্রেয় ২ভাই থাকলে যা পেতেন, তদস্থয়ে বৈমাত্রেয় ২বোন থাকলে দ্বিগুণ পাবেন।

[হিসাব: স্বামী ৩ভাগ+বৈমাত্রেয় ২বোন ৪ভাগ+ মা ১ভাগ = ৬ভাগ। # স্বামী ৩ভাগ+বৈমাত্রেয় ২ভাই ২ভাগ+ মা ১ভাগ = ৬ভাগ।]

৩(১৩) মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা ও মেয়ে জীবিত থাকলে মৃতের মেয়ে সন্তান যা পাবেন মেয়ে না থেকে ছেলে থাকলে এর অনেক কম পাবেন।

[স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + মেয়ে ৬ ভাগ = ১৩ভাগ।

স্বামী ৩ভাগ + পিতা ১ভাগ + মাত ১ভাগ + ছেলে ১ভাগ = ৬ ভাগ।]

৩(১৪) মৃতের স্বামী, মা ও ১জন সহোদরা বোন থাকলে মৃতের সম্পত্তির বোন যা পাবেন, বোন না থেকে যদি ১জন সহোদর ভাই থাকতেন তাহলে তিনি বোন-এর প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম পাবেন।

[স্বামী ৩ভাগ + মা ১ভাগ + সহোদরা বোন ৩ভাগ = ৭ভাগ # স্বামী ৩ভাগ + মা ১ভাগ + সহোদর ভাই ২ভাগ = ৬ভাগ]

প্রশ্ন৭- উপরের উদাহরণগুলোতে সংশ্লিষ্ট পুরুষ সম-পর্যায়ের নয়। সংশ্লিষ্ট নারী/নারীরা রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে মৃতের অধিকতর কাছের স্বজন। তাই, তাঁরা বেশী পাওয়াটা স্বাভাবিক। এমনকোন কোন উদাহরণ আছে কি যাতে রক্তের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের নারী-পুরুষের মধ্যে উত্তরাধিকার বন্টনের সময় নারীরা বেশী পান?

উত্তরঃ নিম্নের উদাহরণ থেকে দেখা যাবে রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে সমপর্যায়ের হওয়া সত্বেও কোন কোন পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষের বেশী পান –

৪(১৫) স্বামী, পিতা, মাতা ও ২জন কন্যার বদলে কোন মুসলিম নারী স্বামী, পিতা, মাতা ও ২জন পুত্র রেখে মারা গেলে পুত্রদের চেয়ে কন্যারা বেশী পরিমাণে সম্পত্তি পাবেন।

[স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + কন্যারা ৮ভাগ = ১৫ভাগ। #

স্বামী ১৫ভাগ + পিতা ১০ভাগ + মাতা ১০ভাগ + পুত্রদ্বয় ২৫ ভাগ = ৬০ভাগ।]

৪(১৬) শুধুমাত্র পিতা, মাতা ও স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় মৃতের সম্পত্তিতে মা, তাঁর বাবার দ্বিগুণ পাবেন।

[পিতা ১ভাগ + মাতা ২ভাগ + স্বামী ৩ভাগ = ৬ভাগ]

কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট নারী রক্তের সম্পর্কের দিক হতে দূরের হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে বেশী পরিমাণে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হন। যেমনঃ

৫(১৭) ওয়ারিস যদি হন স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় ২জন বোন এবং ২জন সহোদর ভাই তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় ২জন বোন, মৃতের আপন ২জন ভাইয়ের চেয়ে বেশী পাবেন।

[স্ত্রী ৩ভাগ + মা ৩ভাগ + সহোদর ২ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ২বোন ২ভাগ করে মোট ৪ভাগ = ১২ভাগ।]

৫(১৮) অনুরূপভাবে ওয়ারিস যদি হন স্বামী, ২জন সহোদর ভাই ও ২জন বৈপিত্রেয় বোন তখনও বৈপিত্রেয় বোনেরা সহোদর ভাইয়ের চেয়ে মৃতের সম্পত্তি পাবেন কম (অর্ধেক)।

[স্বামী ৬ভাগ + সহোদর ২জন ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ২জন বোন ২ভাগ করে মোট ৪ভাগ = ১২ভাগ।]

৫(১৯) স্বামী, মা, ২জন সহোদর ভাই ও ১জন বৈপিত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় মৃতের ভাইয়ের তূলনায় বৈপিত্রেয় বোন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারনে মৃতের সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হবেন।

[স্বামী ৬ভাগ + মা ২ভাগ + সহোদর ২জন ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ১জন বোন ২ভাগ = ১২ভাগ।]

প্রশ্ন৮- কোন্ কোন্ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মিরাছ পান?

উত্তরঃ ১০ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মিরাছ পেয়ে থাকেন-

৬(২০) পিতা-মাতা সমান পান ছেলের ঘরে নাতি থাকলে।

[পিতা ১ভাগ + মাতা ১ভাগ + নাতি ৪ভাগ = ৬ভাগ।]

৬(২১) মৃতের শুধুমাত্র বৈপিত্রেয় ২ ভাই-বোন থাকলে, তাঁরা সমান পাবেন।

[বৈপিত্রেয় ভাই ১ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ভাগ = ২ ভাগ।]

৬(২২) মৃতের ওয়ারিস হিসাবে অন্যান্যদের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে সব ধরনের বোনেরা (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রিয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবেন। যেমন-

[বৈমাত্রেয় ভাই ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ভাই ১ভাগ + বৈমাত্রেয় বোন ১ভাগ + সহোদরা ২জন বোন ১ভাগ করে ২ভাগ = ৬ভাগ।]

৬(২৩) মৃতের একমাত্র কন্যা ও আপন একজন চাচার উপস্থিতিতে উভয়ে অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।

৬(২৪) মৃতের ছেলের ঘরে ছেলে থাকলে নানী, পিতার সমান পাবেন। এক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারছি, এরা ৩জন ছাড়া মৃতের ওয়ারিস-যোগ্য আর কোন স্বজন নাই। [ছেলের ঘরে নাতি ৪ভাগ + পিতা ১ভাগ + নানী ১ভাগ = ৬ভাগ।]

৬(২৫) মাতা, ২জন বৈপিত্রেয় বোন, স্বামী ও ১জন সহোদর ভাই যখন কোন মৃতের ওয়ারিস হন তখন মৃতের মাতা তদীয় সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবেন। [স্বামী ৩ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ২জন ১ভাগ + মাতা ১ভাগ + ভাই ১ভাগ = ৬ভাগ।]

৬(২৬) সহোদর বোন স্বামীর সাথে ওয়ারিস হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে।

[স্বামী ১ভাগ + ভাই ১ভাগ + বোন ১ভাগ = ৩ভাগ।]

৬(২৭) মৃতের স্বামী ও মাতার উপস্থিতিতে অন্য কেউ না থাকলে বৈপিত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান পাবেন।

[স্বামী ৩ভাগ + মাতা ১ভাগ + সহোদর ভাই ১ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ভাগ = ৬ভা্গ।]

৬(২৮) মৃতের ওয়ারিস হিসাবে মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া ওয়ারিস-যোগ্য কেউ জীবিত না থাকলে সবাই সমান অংশ পাবেন। [মেয়ের ছেলে ১ভাগ + মেয়ের মেয়ে ১ভাগ + মামা ১ভাগ + খালা ১ভাগ = ৪ভাগ।]

প্রশ্ন৯- দাদার বর্তমানে পিতার মৃত্যু হলে তাঁর সন্তানেরা দাদার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হন। এটি কি অন্যায় নয়?

উত্তরঃ কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্যরা তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কিভাবে হবেন? এক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের সুরক্ষার জন্য দাদা তাঁর সম্পত্তির এমনকি এক তৃতীয়াংশও ওছিয়ত করতে পারেন যা তাঁদের সম্ভাব্য প্রাপ্য ওয়ারিসী হিস্যারও বেশী হতে পারে।

প্রশ্ন১০- বাবার মৃত্যুর পর দাদা যদি তাঁর মৃত পুত্রের পরিবারকে তদীয় সম্পত্তির অংশবিশেষ ওছিয়ত না করেন বা না করতে পারেন, তাহলে?

উত্তরঃ রাষ্ট্র এই অছি’র ভূমিকা নিতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অছিয়্যতকে বাধ্যতামূলক করতে পারে বা করা হয়েছে ধরে নিতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র তথা কল্যাণ রাষ্ট্র না থাকাতে এ সমস্যা আমাদের দেশে প্রকট। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকলে ওয়ারিস হতে বা যে কোন প্রকারে বঞ্চিতদের দায়িত্ব গ্রহনে সরকার বাধ্য।

প্রশ্ন১১- ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরাও ইসলামী উত্তরাধিকারী আইন মানতে বাধ্য?

উত্তরঃ না, ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যারা এটিকে সঠিক মনে করবে। যেমন, মুসলিমরা।

প্রশ্ন১২- এই উত্তরাধিকার আইন বলবৎ করা ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে?

উত্তরঃ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ে অছিয়ত বা প্রচলিত দেশীয় পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টিত হতে পারে। যেমন তৃতীয় হিজরীর শেষের দিকে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র পরবর্তীকালে বলবৎকৃত উত্তরাধিকার আইন ব্যতিরেকে চলছিল। তখন মৃত্যুকালে অছিয়ত করা মুসলিমদের জন্য অত্যাব্যশক ছিল যা মিরাছী আইনের উপস্থিতিতে ঐচ্ছিক হিসাবে কার্যকর রয়েছে।

প্রশ্ন১৩- ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি কী?

উত্তরঃ ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে-

ক. মৃত ব্যক্তির সাথে ওয়ারিসের নৈকট্য।

খ. নতুন প্রজন্ম বা বংশধর প্রবীণদের তুলনায় বেশি পাবে।

গ. সংশ্লিষ্টের সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা।

পর্যালোচনা / মন্তব্য –

১. উত্তরাধিকার আইনসহ ইসলামী সকল আইন ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামী রাষ্ট্র তথা সমাজ নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক সম্পর্ক-নির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান ও বিবাহ নামক একটি প্রথার উপর নির্ভরশীল।

২. যাঁরা প্রচলিত পরিবার নামক এই মূল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের স্থলে ‘লিভ টুগেদার’কে স্থান দিতে চান, তাঁদের গ্রহনযোগ্য যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে – গে এবং লেসবিয়ান ‘বিয়ে’ আইনসিদ্ধ হলে প্রাণী কিম্বা উপযোগী কৃত্রিম ব্যবস্থার সাথে ‘ভার্চূয়াল বিয়ে’ আইনসম্মত হবে না কেন? যদি হয়, তাহলে সে ধরনের মানবীয় রূচি বিরোধী কার্যক্রমকে বিয়ে বলা হবে কেন?

৩. বিয়ে হচ্ছে নর-নারী সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি ও এ সম্পর্ককে সম্ভাব্য দায়বদ্ধতার সীমা স্থিত করা। এটিকে যদি আমরা মানি, প্রচলিত পরিবার ব্যবস্থাকে আমাদের মানতে হবে। তা যদি মানি, তাহলে অপরাপর যে কোন প্রতিষ্ঠানের মতোই এর একটি স্তর-বিন্যাস থাকা বাঞ্ছনীয়।

৪. ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষ হিসাবে নারী পুরুষ সমান। যেসব ক্ষেত্রে নারীদেরকে দায়িত্বমুক্ত রাখা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির অনুরূপ কর্মবিন্যাস নিশ্চিতকরণ। অধিকারের সাথে দায়িত্ব সম্পর্কিত। বাহিরের ভারী কাজগুলো পুরুষ করবে আর ঘরের হাল্কা কাজগুলো নারীরা করবে।

৫. নারী-পুরুষের ভিন্নতা অলংঘনীয়। এই প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে গ্রহন করেই আমরা সবাই মানুষ। Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) এর প্রাককথনের চতুর্থ প্যারার ‘As defined in article 1, discrimination is understood as any distinction, exclusion or restriction made on the basis of sex…in the political, economic, social, cultural, civil or any other field.’ - এ অংশটুকু নিতান্তই বাড়াবাড়ি নয়কি?

[URL: http://www.un.org/womenwatch/daw/text/econvention.htm on 07th April, 2011]

৬. বৈষম্য (ডিসক্রিমিন্যশান) –এর প্রকৃত অর্থ হওয়া উচিত নারীর উপর পুরুষ কর্তৃক একতরফাভাবে আরোপিত অন্যায্য ও বঞ্চনামূলক বিষয়াদি। আসুন, সেসব চিহ্তি ও প্রতিরোধ করে মানবিক সমতাকে নিশ্চিত করি।

৭. সকল ক্ষেত্রে সমতা – একটি কষ্টকর কল্পনা মাত্র। মানবিক সমতা সত্বেও আইনের ইক্যুইটিবল ডিস্ট্রিবিউশন একটি অপরিহার্য বিষয়। ইক্যুইটি ইজ দ্য ট্রু সেন্স অফ ইকোয়ালিটি। যেটি হচ্ছে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মর্মবাণী।

আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।


সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়েোজিত সেমিনারে (১১/০৪/২০১১) পঠিত

শুক্রবার, ২৩ জুলাই, ২০১০

জ্ঞান ও অন্ধ-বিশ্বাস

আমাদের জ্ঞান কি সীমিত, না অসীম? যদি আমরা অসীম না হই, তাহলে আমাদের জ্ঞান আসলেই কি সত্যিকার অর্থে অসীম হতে পারে? যুক্তিবিদ্যা কী বলে? আমাদের জ্ঞান যদি সসীম হয় তাহলে দর্শনের এই কালো বিড়াল অস্তিত্বহীন নয়। অতএব কোন না কোন দিন এটির গ্রেফতার অবশ্যম্ভাবী, কক্ষ যতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হোক না কেন। যদি আমরা এভাবে সব জ্ঞান পেয়ে যাই, তাহলে আর কি বাকী থাকে ঘটবার? মৃত্যু। মানব জাতির সমাপ্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অতএব, কোনটি? সীমিত, বা অসীম? (অসীম শব্দটির মধ্যে কেমন আধাত্ম-আধাত্ম ফ্লেভার আসে না? উপায়?)
বিশ্বাস হলো প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুকে গ্রহন করা। প্রমান চাইতে গেলেই প্রশ্নকে গ্রহন করতে হবে। প্রশ্নকে এক পর্যায়ে থামিয়ে দেয়া ও যুক্তিছাড়াই বিশ্বাসকে জ্ঞান হিসাবে গ্রহন করা বা করতে বাধ্য করা হলো অন্ধ-বিশ্বাস। এসব আমরা জানি। কিন্তু যা আমরা জানি না তা হলো -
জ্ঞানের জগতে যে কোন প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু সকল প্রশ্নের প্রমানভিত্তিক উত্তর পাওয়া যায় না। যে সব প্রশ্নের (প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অর্থে) উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না সে ক্ষেত্রে আমরা যুক্তির (অবশ্য প্রাপ্ত তথ্যভিত্তিক) উপর নির্ভর করে জ্ঞান নির্মাণ করি।
সকল প্রশ্ন করা যায়, বা করতে পারা উচিত, কিন্তু সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না; এবং উপরের আলোচনা অনুযায়ী সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অনুচিত! (আর কোন প্রশ্ন না থাকলে মৃত্যুছাড়া গত্যন্তর নাই)

কেমন ‘উত্তর’ সঠিক উত্তর? যে ‘উত্তরে’র পরে সে বিষয়ে আর নতুন কোন প্রশ্ন সৃষ্টি হবে না। কৃত প্রশ্নকে উত্তর হিসাবে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে সেট করা হলো ‘বেগিং দ্যা কোশ্চেন’ বিভ্রান্তি। সুতরাং যে কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে জানার তৃষনা নিবারণকারী। তেমন উত্তর কী পেয়েছেন? যদি পেয়ে থাকেন, ভেবেছেন কি, আপনার প্রাপ্ত উত্তর-এর পেছনে আরো সম্ভাব্য প্রশ্ন এসে পড়ে কি-না? কোন পরবর্তী প্রশ্ন সৃষ্টি করবেনা - এমন উত্তর আদৌ কি পাওয়া সম্ভব বা উচিত?

তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাড়ালো যে, সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে বা পাওয়া যাবে - এটি একটা অন্ধ-বিশ্বাস?

আমার মতেঃ প্রশ্নের ব্যাপারে কোন সীমা টানা যাবে না, কিন্তু উত্তর পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে মানতে হবে। অবশ্য অ-প্রাপ্ত উত্তরের ব্যাপারে আমাদেরকে যথাসম্ভব-প্রমাণ তথা যুক্তির উপর থাকতে হবে।যা হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন।

যে সব বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত প্রমান দেয়া সম্ভব নয়, সেসব বিষয়ে অন্যদের প্রদত্ত/গৃহীত যুক্তি ও তৎনির্ভর জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করাই শ্রেয়। নীতি হিসাবে সম্ভবতঃ এটিকে মানবতাবাদ বা জ্ঞানতাত্ত্বিক মানবতাবাদ বলা যেতে পারে।

বুধবার, ২১ জুলাই, ২০১০

বস্তু, শক্তি ও গুণের প্রসঙ্গে আত্মা বা মন সম্পর্কিত ভাবনা

হেগেলের তিনটি সূত্র আছে যেগুলো সাধারনভাবে তাঁর অন্যতম ছাত্র মার্ক্সের নামে প্রচারিত। পরিমাণের গুণে রূপান্তর হলো দ্বিতীয় সূত্র।

বস্তুর ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ ঘটলে নতুন গুণের আগমন ঘটে। যেমন: একটি ঘড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ গুলোকে ‘নির্দিষ্ট’ভাবে একত্রিত (সংযোজন অর্থে) করলে নতুন একটাকিছু পাওয়া যায় - সময়।

এই দৃষ্টিতে গুণ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে বটে তবে তা বস্তু-অতিরিক্ত, কিন্তু বস্তু-নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। গুন বস্তুর অংশও নয়। ঘড়ির যন্ত্রাংশের মধ্যে সময় বলে কোন পার্টস নাই।

গুণ, বস্তু’র থেকে আলাদা কিনা - এই নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে।
মার্কসিস্টরা মনে করেন, মন হলো মস্তিস্কের উপজাত বা বাই-প্রডাক্ট। মন, দেহকে প্রভাবিত করতে পারেনা। দেহই মনকে গঠন করে। এই তত্বের বিপক্ষে অনেক আলোচনা আছে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মার্ক্স-এর মতানুসারে মন-এর স্ট্যাটাস বস্তু’র গুণের সমতুল্য।

মন নিয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারায় ব্যাপক ভেরিয়েশান আছে। মন ও আত্মা কে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজীতে মাইন্ড, সৌল, স্পিরিট - ইত্যাদি আলাদা শব্দ থাকলেও তত্ত্বীয় আলোচনাতে সব কিছুকে মাইন্ড বা মন হিসাবে ট্রিটমেনট করা হয়।

গূণ-কে যদি বস্তুনির্ভর কিন্তু বস্তুর অতিরিক্ত (যেমন ঘড়ি ও সময়ের ধারনা) হয় তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ‘প্রাণ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও আত্মা’র ধারনা নাকচ হয়ে যাবে না। কারণ আত্মা দেহকে ভর করে থাকে অথচ তা দেহাতীত।

আত্মার আর একটি বড় প্রমান হলো - মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও দেহ ইনট্যক্ট থাকে। তাহলে পরিবর্তনটা কী যাকে আমরা মৃত্যু বলছি? সেটি হলো আত্মার অনুপস্থিতি।

আত্মাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু পরবর্তী কোন জীবন আছে কি-না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপরে আমি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিলাম তাতে মন বা আত্মার উপস্থিতি অনিবার্য্য।

এখানে মার্ক্সসিস্টরা বলতে পারেন: দেহের অপরিহার্য্য (বস্তুগত) ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলেই ‘মৃত্য’ ঘটেছে। অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তাই নতুন সিনথেসিস হয়েছে। যেটিকে বলা হয় নিগেশন অব নিগেশন। এখানে মনের বা আত্মার কোন প্রসঙ্গ অবান্তর।

প্রশ্ন হলো: এই ‘বিপরীতের ঐক্য’ কেন নষ্ট হলো? যদি অন্যকোথাও কোন ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারনে এখানে এফেক্ট পড়েছে বলা হয়; তাহলে ‘বেগিং দ্যা কোয়েশ্চন’ হতে বাচার জন্য প্রশ্ন করতে হবে সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন? এভাবে আপনাকে অন্তহীন পরম্পরাতে গিয়ে ‘অসীম’ নামের এক ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করতে হবে (অবচেতনে এটলিস্ট); অথবা স্বীকার করতে হবে যে এই বস্তু তথা দেহে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য এটি ফাংশানিং ছিল। যেটির অনুপস্থিতিতে বস্তু তথা দেহটি সজীব থাকা সত্তেও ফল করেছে। যে ঘটনাকে আমরা মৃত্যু বলছি।

দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ বা সামগ্রিকভাবে দেহ অচল হওয়ার কারনে মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যু ঘটার কারনে দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তাহলে কী সেই ব্যাপার যা বিয়োজিত হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেহ আর কাজ করে না, ধীরে অথবা দ্রুত অচল হয়ে পড়ে?

আমাদের প্রগতিশীল বিজ্ঞানবাদী বন্ধুরা স্বীকার করতে না চাইলেও জীবন-এর জন্য অপরিহার্য এই ‘একটা কিছু’ হলো আত্মা যার সঠিক পরিচয় অজানা। যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ফলাফলকে দেখা যায়। যেটি না থাকলে জীবন-এর সব শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সংক্ষেপে আত্মা হলে জীবনীশক্তি। আত্মাকে যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে দেহে অবস্থিত কিন্তু দেহ-অতিরিক্ত, কখনো কখনো দেহকে নিয়ন্ত্রণকারী মনকে অস্বীকার করার কোন কারন নাই। কথাটি বিপরীতক্রমেও সম-সত্য।
আমাদের সুশীল বন্ধুদের একটা অংশ আত্মাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাঁদের ভয় আত্মা বা মনের জানালা দিয়ে না আবার ধর্মের দূষিত বাতাস ঢুকে পরে আর না জানি এতে ইহজাগতিকতার অতি-পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়ে পরে !

এভাবে ভাবুনঃ বস্তু - শক্তি - গুণ - মন - আত্মা

সুধীবৃন্দ, অতি-বিশ্বাসীরা অ-দেখা আত্মাকে যেমন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও চতুর্পাশ্বস্থ বস্তুনিচয়ের চেয়েও বেশী দেখা মনে করেন, তেমনি আপনারা যারা প্রগতিশীলতা (নিশ্চয়ই মননে)’র দাবী করেন, আপনারা যুক্তির বাহিরে গিয়ে আত্মা বা মনকে অস্বীকার ও বস্তুকে আত্মার সকল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে ‘বস্তু’ নামে জপ করা হতে বিরত থাকবেন। অনুরোধ। দেহাতীরিক্ত কিছু যদি থেকে থাকে, তাকে স্বীকার করে নেয়া ভাল। সেজন্য ঈশ্বরবাদী হতে হবে এমন কথা নাই। ধর্মের (আসলে ধর্মবাদীদের) পক্ষে বিবেচিত হবে এজন্য আত্মা বা মনকে যুক্তি-সংগত হওয়া সত্বেও জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করা ধর্মবাদীদের অজ্ঞতা ও অসহিসনুতার মতোই একটা অগ্রহনযোগ্য ও অনভিপ্রেত চরমপন্থা; বলা যায় এক ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা।

টীকাঃ বিজ্ঞানবাদী - এটি আমার দেয়া। এর সঠিক ইংরেজী কি হবে বুঝতে পারছি না। তবে ধারনাটা এ রকম - বিজ্ঞানবাদী হচ্ছেন তাঁরা যারা বিশ্বাস করেন যে, বিজ্ঞান আমাদেরকে একটি পূর্ণ জীবনাদর্শ দিতে পারে। বিজ্ঞান আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দানে সক্ষম। যা পাওয়া যায় নাই তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞান-ই হলো একমাত্র পন্থা।

আসলে বিজ্ঞান আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তি আমাদের কাজে লাগে। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্টতা হলো প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রাপ্তি। এর বাইরে বিজ্ঞানের যত তত্ত্ব সবই ফিলোসফিক্যাল। নট ফিলোসফি ইট স্যালফ; বাট দেয়ার ট্রেন্ড ইজ ফিলোসফিক্যাল। আমার এক সহকর্মী সায়েন্টিফিক রিয়্যালিজমের উপরে কাজ করে ড. হয়েছেন। তিনি জোরেশোরে বলেন, বিজ্ঞানকে যতটা অবজেক্টিভ দাবী করা (বিজ্ঞানবাদী’রা) হয়, বিজ্ঞান ততটা অবজেক্টিভ নয়। শুধুমাত্র পরীক্ষণ-লব্ধ ফলাফলই (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞান নয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব নির্মাণ-ই লক্ষ্য যাতে অ-দেখা থাকে অনেকটুকু। এ প্রসঙ্গে পপার, কুন, ফিয়ারাব্যান্ড প্রমুখের লেখা পড়ে দেখা যেতে পারে।

শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

logic আর faith এর পার্থক্য কি সবসময় স্পষ্ট ?

logic আর faith এর পার্থক্য কি সবসময় স্পষ্ট ? যেমন ধরুন বিজ্ঞানের রানী অংক শাস্ত্রকে যার মধ্যে জ্যামিতি হলো সবচেয়ে যুক্তি নির্ভর। জ্যামিতির শুরু হয় কতগুলি স্বতসিদ্ধ দিয়ে যেমন -
বিন্দু - এমন যার দৈর্ঘ ,প্রস্থ কিছুই নেই কেবল অবস্থান আছে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোন ‘কিছু’ খুজে পাওয়া যাবেনা যার কেবল অবস্থানা আছে কিন্তু দৈর্ঘ ও প্রস্থ নেই। রেখা এমন যার কেবল দৈর্ঘ আছে প্রস্থ নেই কিন্তু বাস্তবে এমন কোন রেখা নেই যার প্রস্থ নেই। কিন্তু জ্যামিতি পড়তে হলে আমাদের বিশ্বাস করে নিতে হয় বিন্দু আর রেখার সংঙাকে কারন জ্যামিতের সমস্ত logic বিন্দু, রেখা ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত।

এভাবে অনেক ক্ষেত্রে logic এর শুরু হয় বিশ্বাস থেকে (axiomatic or Godly in a sense though axioms are not God in the religious sense, but Godly, i.e., axioms are self-justified.)।

একই ভাবে গনিতে শুন্য ও অসিমের ধারনা কল্পনাপ্রসুত অথচ বিজ্ঞানের সৌধ দাঁড়িয়ে আছে এই কল্পনার উপর বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে

যাক, এই পোস্টের মূল বক্তব্য হলো - বিশ্বাস কে আমরা সাধারণতঃ মনে করি শুধুই বিশ্বাস হিসাবে। হাইপোথিসিস বা প্রকল্প হলো অনুমান যার ভিত্তিতে পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। অনেক বছর আগে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। ফলাফলও ভাল ছিল। বর্তমানে আমি দর্শনের ছাত্র। আমার আগ্রহের বিষয় হলো সমকালীন জ্ঞানতত্ত্ব। আমাদের দেশে হাতেগোণা দু’চার জন এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করেছে। আমাদের প্রচলিত অনেক ধারনা জ্ঞানতত্ত্বে এসে পরিবর্তন হয়ে যায়। এ কথা সত্যি যে আমরা কিছু ধরে নিয়ে সেটির ভিত্তিতে অর্থাৎ সেটিকে অভ্রান্ত ধরে নিয়ে অন্যগুলোকে যাচাই করি। তবে যেটিকে আমরা প্রথমেই (যাচাইকরণ ব্যতিরেকে) গ্রহন করি সেটিকে পরবর্তীতে আমরা আবার পূণঃমূল্যায়ন করতে পারি। দুটো প্রধান তত্বকে ঘিরে এই আলোচনা: ফাউন্ডেশানালিজম ও কোহারেন্টিজম।

গণিতের এক সহকর্মী বিন্দু, রেখা, অসীম, কাল্পনিক সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সে অনুসারে এই পোষ্ট।

জ্ঞানতত্ত্বে সবই বিশ্বাস, কিছু বিশ্বাস শুধুই বিশ্বাস, কিছু বিশ্বাস যাচাইকৃত ও সত্য। শুধুমাত্র সে সব বিশ্বাসই জ্ঞান পদবাচ্য যা যাচাইকৃত ও সত্য। এ অর্থে আমাদের ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানসমূহও মূলতঃ (ইন্দ্রিয়জ) বিশ্বাস। আমার চোখ এই স্ক্রিণকে সাদা দেখাচ্ছে বলে আমি বলছি এটিকে আমি সাদা দেখছি; বা বলছি, এটি সাদা। এক্ষেত্রে আমি, জ্ঞানের কর্তা ও এই স্ক্রীণ, জ্ঞানের বিষয় - এর মাঝখানে আমার ইন্দ্রিয়জ প্রক্রিয়া, এক্ষেত্রে দৃষ্টি-প্রক্রিয়া, ক্রিয়াশীল। এই সম্পর্কটি মাঝখানে দৃষ্টি-প্রক্রিয়া থাকায় একটি অ-প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হলো আমার সত্ত্বা বা আমি ও আমার দৃষ্টি-প্রক্রিয়া তথা চোখের মধ্যকার সম্পর্ক। আমি যৌিক্তকভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার ইন্দ্রিয়সমূহ আমাকে ‘বাস্তব জগত’ সম্পর্কে ‘সত্যিকারভাবে’ সাক্ষ্য দেয় বা বলে যদিও আমার এ বিশ্বাসের ইন্দ্রিয়-অতিরিক্ত কোন প্রমাণ আমার নাই, স্বজ্ঞা যাকে আমরা সাধারনতঃ বলি, কান্ডজ্ঞান ব্যতিরেকে। এজন্য কমনসেন্স বিরোধী কোনকিছুকে বলা হয় কাউন্টার-ইনট্যুইটিভ। দেখুন, কিভাবে আমরা সেন্স-পারসেপশান হতে ইনট্যুইশানে এসে পড়লাম।

আমার এ কথাগুলো আপনাদের কাছে বিদঘুটে লাগাটা স্বাভাবিক। সেদিন ‘মাপকাঠির মাপ কী’ - এই পোস্টে একজন বলল আমরা ফুটকে ইঞ্চি দিয়ে মাপি, ইঞ্চিকে আরো ছোন এককে মাপি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি অত্যন্ত সহজ একটা কথা স্বীকার করতে দ্বীধা করলেন যে, আসলে সব কিছুর মাপ হয়না, অন্ততঃ মাপকাঠির মাপ হয়না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক তথা যুক্তি সংগত।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা বলেছিলেন, অর্থপূর্ণ হতে হলে সব বচনের যাচাইযোগ্যতা তথা পরীক্ষণের উপায় থাকতে হবে। সুতরাং যে কথার কোন বাস্তব পরীক্ষণ সম্ভব নয় তা অর্থপূর্ণ নয়। আর অর্থপূর্ণ না হলে তা সত্য বা মিথ্যা হওয়ার আর কোন অবকাশ থাকেনা। সুতরাং সেটি পরিত্যাজ্য তথা অর্থহীন, আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। লজিক্যাল পজিটিভিষ্টদের এই দাবীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত চোখা চোখা সব যুক্তির আলোচনাতে ব্লগের পরিবেশ ভারাক্রান্ত না করে বোদ্ধা পাঠকের জন্য শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট হবে যে, সবকিছু পরীক্ষণের আওতায় আসতে হবে - এই বাক্যের পরীক্ষণ কি? নাই। এই বাক্যকে মূলনীতি হিসাবে ধরে নিয়েই সব কিছুকে পরীক্ষণের প্রয়াস গ্রহন করা হয়।

বলা হয়, কোন অজানা সংখ্যাকে এক্স ধরে সমীকরণ করলে অজানা সংখ্যাটি সত্যি সত্যি বা বাস্তবিকই এক্স হয়ে যায় না। কথা ঠিক। কিন্তু যদি প্রাপ্ত ফলাফল এটিকে এক্স বলতে আপনাকে বাধ্য করে, অজানা সংখ্যাটিকে যদি ওয়াই ধরা হলে যদি সমীকরণ না মেলে? তথন নিশ্চয়ই আপনি ফলাফলে প্রাপ্ত এক্সকে ওয়াই বলবেন না । অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা প্রদত্ত বা আরোপিত নামকে বদল করে দিতে পারি যদি তা প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। কোনকিছুর মান যদি হয় ৫ আর এক্স-এর মান ৫ আর ওয়াই-এর মান ২ হয় তাহলে আপনি অজানা সেই কোনকিছুকে কতক্ষণ এক্স আর কতক্ষণ ওয়াই বলতে পারবেন না। এর মোটিভ হচ্ছে বিশ্বাস-এর সাথে যুক্তি ও প্রমাণ -এর সম্পর্ক নির্ণয় করা। বিশ্বাস হতে যুক্তি ও প্রমান অবশ্যই আলাদা বটে কিন্তু বিশ্বাস হলো ভিত্তি ও পরিণতি।

ধারা্টা এমন: প্রাথমিক বিশ্বাস - হতে অনুমান। অনুমানের পক্ষেবিপক্ষে যুক্তি নির্মাণ। যুক্তিরভিত্তিতে - তত্ত্বগত প্রমান-প্রয়াস। প্রমাননির্ভর বিশ্বাস = জ্ঞান। উল্লেখ্য যে, কোন জ্ঞানই নীতিগতভাবে বা স্বয়ং অপরিবর্তনীয় নয়। যে ‘জ্ঞান’এ বিশ্বাস নাই, জ্ঞানতত্ত্ব মোতাবেক তা আদৌ জ্ঞান হিসাবে গণ্য হতে পারে না।

আমরা যা কিছু দেখি তা জ্ঞান নয়, যা কিছুর ভিত্তিতে দেখি ও দেখে যা কিছু মনে করি - জ্ঞান হলো সেসব কিছুর সমষ্টি

মনে করুন একটি বৃত্ত যেটি বিশ্বাসে পূর্ণ। এর মধ্যে আর একটি উপবৃত্ত যা হলো সত্যতায় পূর্ণ। এটির মধ্যে আরও একটি ক্ষুদ্রতর বৃত্ত যা হলো যতটুকু যাচাই করে পাওয়া গেছে তার সমষ্টি। এক্ষণে, অন্তস্থঃ এই দুই উপবৃ্ত্ত নিয়ে যে মুল বৃত্ত তা-ই হলো জ্ঞান। অতএব আপনার বিশ্বাসের পরিধি যতটা বাড়াবেন কমাবেন সে অনুযায়ী আপনার জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন হবে। অথচ সবসময়েই সত্যতা অভিন্ন আর যাচাই প্রায়-অভিন্ন থেকে যায়। এটি হ লো JTB = K - এর ব্যাখ্যা।

রবিবার, ১১ জুলাই, ২০১০

আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক প্রসঙ্গে

প্রসঙ্গঃ একজন ব্লগার লিখলেন - নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না তবুও তিনি আস্তিক তথা বিশ্বাসী

যদি নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে না পারেন, তাহলে আস্তিক হলেন কিভাবে? অর্থাৎ, নাস্তিকতাই যদি যুক্তি সংগত হয় তাহলে আপনার ‘বিশ্বাসের’ কি মূল্য? আমি যতটুকু জানি, ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী আল্লাহও চান না মানুষ না বুঝে, যুক্তিসংগত হিসাবে গ্রহন করা ছাড়াই, ঈমান আনুক ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী ঈমান বা বিশ্বাসের মধ্যে অন্তরের উপলব্ধি, মৌখিক দাবী ও কর্মগত সাদৃশ্য এই তিন-এর সমন্বয় বা অন্তর্ভূক্তি অপরিহার্য্য

তাই আমি মনে করি, নাস্তিকদের সাথে কেউ যদি যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে তাঁর আস্তিক থাকার কোন কারন নাই জ্ঞানবিহীন বিশ্বাস অর্থহীন, অসম্ভব

স্মর্তব্য যে, নাস্তিকতাকে খন্ডন করা আস্তিক হওয়ার অপরিহার্য্য শর্ত নয় আস্তিকতার যুক্তি আছে - কেবলমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট

আস্তিকতাকে খন্ডন করা প্রচেষ্টা যেমন নাস্তিকদের একটা শ্রেণীগত বিভ্রান্তি বা ক্যাটাগরী মিস্টেক তেমনি নাস্তিকতাকে খন্ডন করার জন্য আস্তিকদের প্রচেষ্টাও সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীগত বিভ্রান্তি বটে

কারন -

‘প্রমান’ দিয়ে ‘বিশ্বাস’ হয় না ‘বিশ্বাসে’র ভিত্তি হলো ‘যুক্তি’ এবং ‘যুক্তি’ই হলো ‘জ্ঞানে’র ভিত্তি, উপাদান ও মৌলিক কাঠামো

তাই -

অনুমান ছাড়া শুধুমাত্র ‘প্রমান’ দিয়ে ‘জ্ঞান’ হয় না ‘প্রমান’ লাগে, যেটি হলো তথ্য যা ‘জ্ঞানে’র একক যেমন দালানের জন্য ইট-এর খন্ড গুলোকে আমরা দালানের একক বলতে পারি তথ্য ও জ্ঞানের পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তথ্য ছাড়া জ্ঞান হয়না তাই বলে সব তথ্য জ্ঞান নয় তথ্যের ‘নির্দিষ্ট সমাহার’ হলো্ জ্ঞান অনুমান-ই হলো এই ‘নির্দিষ্ট সমাহার’ শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট অনুমান-কে হতে হবে যুক্তি-সংগত

সকল জ্ঞানই মূলতঃ বিশ্বাস (বা অনুমান) কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয় জ্ঞান হলো যুক্তিসংগত সত্য বিশ্বাস

অতএব, অ-যৌক্তিক বিশ্বাস-ই হলো অন্ধ-বিশ্বাস কেউ যদি স্বীকার করেন যে, নাস্তিকদের যুক্তি অধিকতর গ্রহনযোগ্য, তাহলে তিনি একজন নাস্তিক সামাজিক কারনে তিনি নিজেকে নাস্তিক পরিচয় না দিলেও

আমাদের সমাজে নাস্তিকরা সাধারনতঃ নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না মজার ব্যাপার হলো অনেকেই জানেন না যে, তিনি নাস্তিক নাস্তিকতাকে এখানে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয় জন্মগতভাবে কেউ আস্তিক বা নাস্তিক হন না আস্তিকতা বলুন, নাস্তিকতা বলুন - এগুলো অর্জন করতে হয়

আমাদের দেশে সবাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আস্তিকতো বটেই, এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানরাও ‘মুসলিম’! কারন, ‘রাষ্ট্রধর্ম’(!) হলো ইসলাম কী বিচিত্র ! ইসলাম অন্ততঃ ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হওয়ার কোন ব্যাপার নয় অবুঝ (জন্মগতভাবে) মুসলিমরাই ইসলামের বড় সমস্যা

আস্তিক হোন আর নাস্তিক হোন - জেনে-বুঝে হোন হঠকারী (এক্সট্রিম) হবেন না যা কিছুর ‘যু্ক্তি নাই’ তা পরিত্যাগ করুন যুক্তিবাদী হোন, তাহলেই সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে পারবেন (ভালভাবে) [link|http://www.somewhereinblog.net/blog/mhq/29183019|বাঁচতে হলে আমাদেরকে সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে হবে বিশ্বাসের বিষয় যা-ই হোক না কেন]


বিঃ দ্রঃ যারা বিপরীত মত-কে গালি দানে ধন্য হোন, তাঁরা দয়া করে মন্তব্য দানে বিরত থাকবেন

বুধবার, ৩০ জুন, ২০১০

প্রসঙ্গ যুদ্ধাপরাধ (সংকলিত লেখা)

‘‘১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ শুধু অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থীরাই করেনি। বাঙালিরাও তখন যুদ্ধাপরাধ করেছে। যুদ্ধাপরাধের অর্থ শুধু স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা নয়। যুদ্ধের সময় নিরপরাধ ব্যক্তি এবং আত্দসমর্পণকারী ব্যক্তিদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করাও অপরাধ। এ কাজ তখন দুই পক্ষেই হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অনেক অবাঙালি নিরাপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধ ব্যক্তি বাঙালিদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে। আমি নিজের চোখে এ হত্যাকাণ্ড দেখেছি মার্চ মাসের শেষদিকে। আমার আত্দজীবনী 'আমার জীবন'-এর তৃতীয় খণ্ডে আমি এর বর্ণনা দিয়েছি (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩)। এটা এমন ব্যাপার ছিল, যা গোপন বা অস্বীকার করার উপায় নেই।
'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর' নামে একটি বই ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে 'প্রথমা' প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। গোলাম মুরশিদ লিখিত বইটিতে এ বিষয়ের কিছু উল্লেখ আছে। এর থেকেও মনে হয়, অবাঙালিদেরও যে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার এবং তাদেরও যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে_এ চিন্তা মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত লোকদের ছিল না। এ জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সময় বাঙালিরা এমনভাবে অনেক অবাঙালি নিধন করেছিল, ঠিক যেভাবে বাঙালি নিধন করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, "আইন হাতে তুলে নেওয়ার একটি বড় রকমের দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৮ তারিখ মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে। এই সমাবেশে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা দেশ গড়ার ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহ দেন।...কিন্তু এই সমাবেশের পরেই হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধারা চারজন 'দালাল'কে পেটাতে আরম্ভ করেন। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে নিয়ে গর্ব করতাম আমরা সবাই। সত্যিকার অর্থে তিনি যেভাবে নিজে একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। যেভাবে যুদ্ধ করে তিনি টাঙ্গাইল অঞ্চল দখল করে রাখেন, তাও অবিশ্বাস্য। বস্তুত তিনি সবারই শ্রদ্ধা অর্জন করেন। কিন্তু ১৮ তারিখে 'দালাল' পেটানোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদেশি টেলিভিশনের সামনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে এই দালালদের হত্যা করেন" (মাঈদুল, ১৯৯২)। বলাবাহুল্য, আইন হাতে তুলে নেওয়ার এ দৃষ্টান্ত শ্রদ্ধার বস্তু ছিল না। বহু দেশেই এই ঘটনার ছবি দেখানো হয়। ফলে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বসমাজের যে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই তাতে ভাটা পড়তে আরম্ভ করে (পৃষ্ঠা: ১৭৬-'৭৭)। 'কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে এক দালালকে হত্যা করতে যাচ্ছেন'_এই শিরোনামে একটি ছবিও এতে ছাপানো হয়েছে; যাতে দেখা যাচ্ছে কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে একজনকে হত্যা করে আর একজনকে হত্যা করছেন।

এই অবাঙালি নিধনের জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাঙালিদের কারো কোনো বিচার হবে এমন চিন্তা বাংলাদেশে দেশদ্রোহিতার শামিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে এর মধ্যে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশের উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে, যে চরিত্র কোনো মতেই প্রশংসাযোগ্য নয়।’’
(বদরুদ্দীন উমর ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে’ কালের কন্ঠ, ০১/০৭/২০১০)